ইরানের সেজ্জিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র: অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩-এর ১২তম ধাপে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ ব্যবহার

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের সেজ্জিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা এই ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই অত্যাধুনিক দুই-পর্যায়ের কঠিন জ্বালানিচালিত মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ২,০০০ থেকে ২,৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং এর গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৪,৩০০ কিলোমিটার (ম্যাক ১২-১৪)। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইরানের অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩-এর ১২তম ধাপের অংশ হিসেবে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যা ইসরায়েলের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ হিসেবে পরিচালিত হয়

অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩ এবং সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র

আইআরজিসি-র মতে, সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি এবং গোয়েন্দা কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এই অপারেশনটি ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রতিশোধ হিসেবে শুরু হয়, যেখানে ইরানের দাবি, ইসরায়েলি বিমান হামলায় আইআরজিসির ঊর্ধ্বতন কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং বেসামরিক নাগরিক, যার মধ্যে শিশুরাও রয়েছে, নিহত হয়েছে। আইআরজিসি দাবি করেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের বহু-স্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যেমন আয়রন ডোম এবং ইউএস-সমর্থিত টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) সিস্টেমকে ভেদ করতে সক্ষম।

ইরানি সংবাদমাধ্যম তাসনিম নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ জুন, ২০২৫ সন্ধ্যায় শুরু হওয়া ১২তম ধাপে সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে তিনটি ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যার প্রতিটি ৭০০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। আইআরজিসি আরও দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের আকাশসীমার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে এবং তাদের পূর্ববর্তী হামলাগুলো ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে।

ইউএস থাড সিস্টেমের ভূমিকা

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইরানের নিক্ষিপ্ত একটি সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্রীয় ইসরায়েলের দিকে আসছিল, যা ইউএস-এর থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে। এই ঘটনায় কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। থাড সিস্টেম, যা ইউএস এবং ইসরায়েলের যৌথ সহযোগিতায় পরিচালিত হয়, দীর্ঘ-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকর। এটি বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তর এবং মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম।

ইসরায়েলের বহু-স্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যার মধ্যে আয়রন ডোম, ডেভিডস স্লিং এবং অ্যারো ২ ও ৩ রয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, ইরানের দাবি, তাদের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র, যেমন সেজ্জিল এবং ফাত্তাহ-১ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।

আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে। ইরানের আইআরজিসি ইসরায়েলি বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের জন্য ইসরায়েলের আকাশ এখন উন্মুক্ত। ইরান আরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ইসরায়েল যদি পাল্টা হামলা চালায়, তবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে।

ইউএস এই সংঘাতে ইসরায়েলের পাশে থেকে সামরিক সহায়তা প্রদান করছে। পেন্টাগন থাড এবং প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে এবং ইউএস নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ারগুলো ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সহায়তা করছে। তবে, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের পরিচালক টম কারাকো সতর্ক করে বলেছেন, ইউএস এবং ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা স্টক সীমিত, এবং অবিরাম হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র এবং গোয়েন্দা সুবিধাগুলোতে পাল্টা হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে তেহরানে অবস্থিত একটি অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কারখানাও রয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের হামলা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সম্ভাব্য প্রভাব

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের এই সাম্প্রতিক পর্ব আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। আইআরজিসি-র সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার ইরানের ক্রমবর্ধমান সামরিক সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়, যা ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তবে, ইউএস-এর থাড সিস্টেমের সফল ইন্টারসেপশন ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনও কার্যকর রয়েছে, যদিও ক্রমাগত হামলা এই ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

এক্স প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীরা এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করছেন। অনেকে সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের ২,০০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লা এবং এর দ্রুত প্রস্তুতির ক্ষমতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তবে, এই তথ্যগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, এবং সংঘাতের প্রকৃত প্রভাব এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।

উপসংহার

ইরানের সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার এবং ইউএস থাড সিস্টেমের মাধ্যমে এর প্রতিরোধ মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতের জটিলতা তুলে ধরে। উভয় পক্ষই তাদের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করছে, যা আঞ্চলিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, এবং ফ্রান্সের মতো দেশ ইতিমধ্যে ইসরায়েল ও ইরান থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংঘাতের পরবর্তী ধাপ এবং এর ফলাফল মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

Source

Scroll to Top